বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ?
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় সমূহ বর্ণনা কর।
স্বাধীন বিচার বিভাগ আধুনিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি। জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার বিভাগের কোন বিকল্প নেই। বিচার বিভাগ হচ্ছে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত ও শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রয়োগকৃত আইনের ব্যাখ্যাদাতা। তাছাড়া বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যাদাতা এবং অভিভাবকও বটে। দেশের শাস্তি ও ন্যায়নীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় না। এছাড়া প্রচার মাধ্যমের বিকাশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা জন্যও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জরুরি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
চাপ, ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার ঊর্ধে উঠে রায় প্রদানের ক্ষমতাকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে। সাধারণ অর্থে, আইনের ব্যাখ্যাদানে ও রায় প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মতামত
প্রকাশের ক্ষমতাকে স্বাধীন বিচার বিভাগ বলা হয়। বোধগম্য কারণেই সত্য যে, বিচার বিভাগ যদি শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের হস্তক্ষেপ ও হুমকিমুক্ত হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে এর স্বাধীনতা থাকে না। তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্থ বিচারকদের অবাধ ক্ষমতা বা খেয়াল খুশিমত কিছু করার ক্ষমতাকে বোঝায় না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বিচারকদের দৃঢ় মনোবল, প্রখর বুদ্ধি, আইনসংক্রাস্ত উন্নত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ, প্রজ্ঞা, সততা ও স্বাধীন বিচার ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, রাষ্ট্র কীভাবে তার বিচার কার্য সম্পন্ন করছে তা জানতে পারলেই রাষ্ট্রের নৈতিক চরিত্রের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
বেকন (Bacon) বলেছেন, “বিচারকদের হতে হয় সিংহের মতো, কেননা সিংহাসনের ছত্রছায়া তাদের ওপর থাকবে।”
অর্থাৎ বিচারকগণ অসীম সাহসের সাথে বাহ্যিক সকল প্রভাব উপেক্ষা করে ন্যায্য রায় প্রদান করবেন।
লর্ড ব্রাইস এর মতে, “There is no other alternative to determine the goodness of the government but the fitness competence of the judiciary.” অর্থাৎ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। ন্যায় বিচারের ক্ষমতা হলো ভালো সরকার যাচাইয়ের শ্রেষ্ঠ মানদন্ড।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী
মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও অন্যান্য শক্তির প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করার স্বাধীনতাকে বোঝায়। অর্থাৎ কোনো বিচার বিভাগকে
তখনই স্বাধীন বলা যাবে যখন এটি সকল প্রকার বাহ্যিক চাপ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকবে। এবং রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্রতা বজায় রাখবে। অর্থাৎ,এটি এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ
তিনটি বিভাগ যথা- শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ নিজ নিজ ক্ষমতা চর্চা করবে। যেখানে বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করবে। বিচারক সমস্ত ধরনের মোহ, অন্যায়, চাপ, বিরাগমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে রায় দিবেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো:
১। বিচারক নিয়োগ: বিচারকদের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। তাই বিচারক
নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিদের বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে।
২। বিচারকদের পদোন্নতি: বিচারকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সঠিক সময়ে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিচারকদের কর্মস্পৃহা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পাবে। আর পদোন্নতি হচ্ছে কারো কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের শ্রেষ্ঠ উপায়।
৩। উপযুক্ত বেতন-ভাতা: নিজেরসহ পরিবারের যথাযথ ভরণপোষণ মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই বিচারকগণ যাতে সম্মান এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য যথাযথ বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করতে
হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য পৃথক বেতন স্কেলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। কার্যমেয়াদ: বিচারকদের কার্য মেয়াদের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে যাতে তারা নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগেন।
কার্যমেয়াদের স্থায়িত্ব বিচারকগণকে নির্ভয় চিত্তে দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করবে যা রায় প্রদানে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
৫। বিচারকদের সামাজিক মর্যাদা: সামাজিক মর্যাদা বিচারকদের আত্মসন্তুষ্টি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সমাজে বিচারকদের অবস্থান ও মর্যাদা বৃদ্ধিকরার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য: বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের থেকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে।
৭। বিচারকদের প্রশিক্ষণ: বিচারকদের দক্ষতা ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। বিচারকদের নিরাপত্তা: নিরাপত্তার অভাবে বিচারকগণ অনেক সময় ন্যায্য রায় প্রদানে ব্যর্থ হন। তাই বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৯। আদালত ভবনের নিরাপত্তা: আদালত ভবনকে সুরক্ষিত করতে হবে, যাতে সেখানে কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা বজায় থাকে। এতে করে বিচারকগণ স্বস্তির সাথে কাজ করতে পারবেন। তাদেরকে আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে না।
১০। বিচারকদের নিঃস্বার্থতা: বিচারক হবেন নিঃস্বার্থ এবং যে কোনো প্রকার ব্যক্তি বা শ্রেণীস্বার্থের ঊর্ধ্বে। এতে তাদের
রায়ের নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
১১। আইন বিষয়ে দক্ষতা: বিচারকগণ আইন বিষয়ে যত দক্ষ হবেন, বিচারকার্যে তত বেশি কর্তৃত্ব করতে পারবেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বিচারকদের পেশাগত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
১২। সুশিক্ষিত ও দক্ষ আইনজীবী: বিচারের রায় অনেকটা নির্ভর করে আইনজীবীদের উপর। তাই আইনজীবীরা যত বেশি সুশিক্ষিত ও
দক্ষ হবেন, বিচারকদের জন্য সঠিক রায় প্রদানে তা তত বেশি সহায়ক হবে। তাছাড়া বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে ভুল
বোঝাবুঝির সুযোগ হ্রাস পাবে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সহায়ক হবে।
অতএব সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন। তাই
বিচার বিভাগকে অন্যান্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক
সরকারের জন্য অপরিহার্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই নাগরিক স্বাধীনতার সর্বোত্তম গ্যারান্টি। যথাযথ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষণ ও সংবিধান সমুন্নত রাখতে স্বাধীন বিচার বিভাগের বিকল্প নেই।